শুক্রবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:৩৯ পূর্বাহ্ন
ভয়েস নিউজ ডেস্ক:
কয়েক বছর ধরে অব্যাহত দরপতনের কারণে লোকসান দিয়েই রাবার উৎপাদন কার্যক্রম চালিয়ে এসেছেন রাবার বাগান মালিকরা। ক্রমাগত লোকসানের কারণে বর্তমানে রাবার চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন তারা। অনেকেই বাগান বিক্রি করে ব্যবসা গুটিয়েও নিচ্ছেন।
রাবারের গাছ থেকে সংগৃহীত হয় কষ, যা লেটেক্স নামে পরিচিত। এ কষ প্রক্রিয়াজাত করে তৈরি হয় রাবার। প্রতি কেজি রাবার উৎপাদনে কষের প্রয়োজন পড়ে চার লিটার। এক কেজি রাবার উৎপাদনে বাগান মালিকের খরচ পড়ে ৭০-৮০ টাকা। অন্যদিকে কেজিপ্রতি রাবারের গড়মূল্য ১০০ টাকা। এ বিক্রির ওপর আবার ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট পরিশোধ করতে হয় বিক্রেতাকে। ফলে অন্যান্য খরচ যোগ করে লাভের চেয়ে লোকসানই গুনতে হয় বেশি। এ অবস্থা চলছে কয়েক বছর ধরে। বাগান মালিকদের অনেকে ধৈর্য ধরে এতদিন ব্যবসা চালিয়ে গেলেও অব্যাহত লোকসানের কারণে শেষ পর্যন্ত রাবার চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।
এমনই একজন মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার আব্দুল মতলিব। বছর তিনেক আগে নিজের রাবার বাগানের গাছ কেটে ফেলেছেন মতলিব। তিনি বলেন, প্রায় পাঁচ বছর ভর্তুকি দিয়ে বাগান চালু রেখেছিলাম। দাম বাড়ার আশায় ছিলাম। কিন্তু দিন দিন দাম কমছেই। ফলে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম। এ কারণে সব গাছ কেটে বিক্রি করে ফেলেছি।
একই উপজেলার বাসিন্দা সুইট খানেরও এক সময় দুটি রাবার বাগান ছিল। উৎপাদিত রাবারের দাম না পেয়ে একটি বিক্রি করে দিয়েছেন তিনি। আরেকটি এখনো থাকলেও চলমান কভিড-১৯ মহামারীর কারণে সেটিরও কার্যক্রম বন্ধ।
সুইট খান বলেন, এখন করোনার সময়ে সবার অবস্থাই খারাপ। কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থায়ও রাবারের দাম পাওয়া যায় না। উৎপাদন খরচও অনেক সময় ওঠে না। ফলে রাবার বাগান করায় উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন সব চাষীই।
সিলেট বিভাগের বিভিন্ন অঞ্চলের রাবার মালিকদের সঙ্গে কথা বলে এ কথারই পুনরাবৃত্তি শোনা গিয়েছে বারবার। তারা জানান, ২০১০-১২ সালেও প্রতি কেজি রাবারের দাম ছিল ২৮০-৩২০ টাকা। ২০১৩-১৪ সালে তা নেমে আসে ১২০-১৩০ টাকায়। বর্তমানে প্রতি কেজি রাবার ১০০-১১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ এককালে রাবারকে বলা হতো ‘সাদা স্বর্ণ’। আশির দশকে সরকারের কাছ থেকে ব্যাপক প্রণোদনা ও উৎসাহ পেয়ে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠে অনেক রাবার বাগান।
উদ্যোক্তারা বলছেন, বিদেশ থেকে আমদানি বাড়ায় দেশে উৎপাদিত রাবারের দাম কমে গেছে। এছাড়া রাবারের কাঁচামাল কৃষিপণ্য হওয়া সত্ত্বেও এটিকে এখন বিবেচনা করা হচ্ছে শিল্পপণ্য হিসেবে। এ কারণে বাগান মালিকদের বিক্রীত রাবারের ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট পরিশোধ করতে হচ্ছে। এ কারণে আরো বিপাকে পড়ে গিয়েছেন বাগানের উদ্যোক্তারা। লোকসান গুনছে সরকারি বাগানগুলোও।
বাগান মালিকদের অভিযোগ, সরকারের উদাসীনতা, সনাতন আবাদ পদ্ধতি অনুসরণ ও শিল্পোদ্যোক্তাদের অনাগ্রহের কারণেও দেশে রাবার শিল্পের সংকট ঘনীভূত হয়েছে।
মৌলভীবাজারের বরমচালের কলিমউল্লা রাবার বাগানের স্বত্বাধিকারী টিপু চৌধুরী বলেন, ১৯৯০ সালে আমি বাগান শুরু করি। তখন ২৮০ টাকায় প্রতি কেজি রাবার বিক্রি করেছি। কিন্তু ১৫ বছর ধরে রাবারের দাম কমেছে। বর্তমানে প্রতি লিটার রাবারের কষ বিক্রি হচ্ছে ২৫ টাকায়। চার লিটার কষে এক কেজি রাবার হয়। ফলে এক কেজি রাবার বিক্রি করে দাম পাচ্ছি ১০০ টাকা। এ ব্যবসায় এখন লাভের চেয়ে লোকসানই বেশি।
বাংলাদেশে বর্তমানে সরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা রাবার বাগানের সংখ্যা ১৮। এর মধ্যে চট্টগ্রাম জোনে নয়টি, টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ জোনে পাঁচটি ও সিলেট জোনে চারটি বাগান রয়েছে। এর মধ্যে সিলেট অঞ্চলের ভাটেরা, সাতগাঁও, শাহজীবাজার ও রূপাইছড়া বাগানে মোট ৮ হাজার ৪৪২ দশমিক ২২ একর জমিতে রাবারের চাষ করা হয়। এছাড়া সিলেট অঞ্চলে বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা রাবার বাগান রয়েছে শতাধিক।
অথচ শুধু দেশের চাহিদা মিটিয়েই রাবারের উৎপাদন লাভজনক করা সম্ভব ছিল। সংশ্লিষ্টরা জানান, সব মিলিয়ে দেশে বর্তমানে প্রায় ৭০ হাজার একর জমিতে রাবারের চাষ হচ্ছে। বার্ষিক উৎপাদন ১৬ থেকে ২০ হাজার টন। অন্যদিকে শুধু স্থানীয় বাজারেই পণ্যটির বার্ষিক চাহিদা ৩০ হাজার টন।
এদিকে, সিলেট অঞ্চলের সরকারি বাগানের বেশির ভাগ গাছেরই অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল ফুরিয়েছে অনেক আগেই। নতুন গাছ আমদানি বা রোপণেরও উদ্যোগ নেই। বনবিভাগও রাবার বাগানের জন্য নতুন জমি দিতে আগ্রহী নয়।
সরকারি একটি রাবার বাগানের ব্যবস্থাপক নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, সিলেট জোনের চারটি সরকারি বাগানই পুরনো। এসব রাবার বাগানে উৎপাদন ভালো। কিন্তু বিক্রয়মূল্য কম হওয়ায় লোকসানের সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
সরকারি বাগানের আয়ুষ্কাল হারানো এসব রাবার গাছের কাঠ আহরণের জন্য শ্রীমঙ্গলে একটি রাবার কাঠ প্রেসার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে। ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে এখানে অর্থনৈতিক জীবনচক্র হারানো রাবার গাছের কাঠকে প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে ব্যবহার উপযোগী টেকসই কাঠে রূপান্তর করা হচ্ছে। প্ল্যান্টটি প্রতিদিন ১৬০ ঘনফুট হিসেবে বছরে ৪৮ হাজার ঘনফুট কাঠ প্রক্রিয়াজাত করতে সক্ষম।
দেশে রাবার শিল্পের বর্তমান অবস্থা নিয়ে কথা বলতে বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশনের রাবার বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা এ বিষয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। সূত্র:বনিকবার্তা
ভয়েস/জেইউ।